
মেভটাইমস ডেস্কঃ বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে পৃথিবীর ২২২টি দেশে সাড়ে সাতশ কোটি মানুষ গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। বাংলাদেশেও এর ভিন্নতা কিছু নেই। গত বছরের মার্চ থেকে আমরা করোনার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছি।
এখনো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ঢেউ আমাদেরকে চরম উদ্বেগের মধ্যেই রেখেছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে দেশের অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত নানাভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। বিশেষত ক্ষুদ্র, মাঝারি এমনকি বেশ কিছু বড় শিল্প এই সময়ে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ছোট ও মাঝারি ব্যবসা বলতে গেলে পুঁজি হারা হয়ে পড়েছে। এর ফলে লাখ লাখ মানুষের আয় কমতে কমতে অস্তিত্বের সংকটের প্রান্তসীমায় নিয়ে এসেছে। করোনা চিকিৎসায় বিশ্বের কারোরই কোনো অভিজ্ঞতা ও প্রস্তুতি ছিল না। আমাদেরও তাই। আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অনুসরণ করে করোনার চিকিৎসায় হাসপাতাল, চিকিৎসক, অক্সিজেন, আইসিইউ, নার্স, টেকনিশিয়ান প্রস্তুত করেছি। কিন্তু ডেলটা ঢেউ আমাদের চিকিৎসা প্রস্তুতিকে অনেকটাই যেন অসহায় অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। গ্রামগঞ্জে অসংখ্য মানুষ ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হয়েছিলেন। ফলে তাদের চিকিৎসা প্রত্যাশিত মানে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সবচাইতে বিপদে আমাদেরকে ফেলেছে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত টিকার সরবরাহ।
আমাদের চাহিদা অনুযায়ী টিকা পেতে আরও বেশি অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ডেল্টা ভাইরাস আমাদেরকে ততদিনে কতটা স্বস্তিদায়ক জায়গায় রাখবে সেটি বলা কঠিন। সে কারণে বেশিরভাগ মানুষই টিকা প্রাপ্তি নিয়ে বেশ আশংকার মধ্যে আছে।
অন্যদিকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা গত বছরের মার্চ মাস থেকে করোনার কারণে বন্ধ হয়ে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। ডেলটার ঢেউয়ে সব ভেসে গেছে। আবার এখন প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এবারও স্বস্তির জায়গায় পৌঁছার মতো অবস্থানে আমরা এখনো নেই। সংক্রমণের হার ১৫ শতাংশের নিচে আসেনি উল্লেখ করেন লেখক।
বিশেষজ্ঞরা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে না আসা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে অভিমত দিচ্ছেন না।
শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে হেলাফেলা করা যায় না। কিন্তু ওরাও তো দেড় বছরের অধিক সময় ধরে ঘরে বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে রয়েছে। ছোটরা স্কুল ছাড়া বন্ধুহীনভাবে লেখাপড়ায় আনন্দ পায় না। যদিও শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তাতেও এইসবে ছোটদের মন ভরে না, লেখাপড়ায় আগ্রহী করে রাখা যায় না। ফলে তাদের মধ্যে চলছে বড় ধরনের মানসিক অস্থিরতা।
অভিভাবকরাও সেই অস্থিরতায় কম বেশি ভুগছেন। আবার শিশুদের এই অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতেও তাদের আতঙ্কের শেষ নেই। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংকট আরও বেশি। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এই দেড় বছর শিক্ষাক্রম থেকে দূরে রয়েছে। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ উভয় সংকটে পড়েছে। পরিবারের অনেকেরই আর্থিক সংকট বেড়ে গেছে। কেউ কেউ উপার্জনে কোথাও না কোথাও কর্ম খুঁজে নিতে চেষ্টা করছে। আবার অনেকের শিক্ষাজীবনটা শেষ করতে পারলে একটা চাকরির জন্য তারা দরখাস্ত করতে পারতো। তারাও আটকে আছেন এপাড়ে, যেতে পারছেন না ওপাড়ে।
গত বছর এস এস সির পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসতে পারলেও এইচএসসির পরীক্ষার্থীরা পারেননি।
শিক্ষাবোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের গড় নম্বর করে যেভাবে ফলাফল দিয়েছে তাতে অনেকেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এবার উভয় পরীক্ষার প্রস্তুতি থাকার পরও ডেলটা ঢেউ তাদেরকে সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
এখন শিক্ষাবোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এস এস সি ও এইচ এস সি পরীক্ষা যথাক্রমে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুষ্ঠিত করতে চাচ্ছে। সেটিও নির্ভর করবে করোনা ঢেউ কতটা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসবে তার ওপর। ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর অভিভাবক উদ্বিগ্ন আছেন তাদের নিয়ে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে কিন্তু বেশ কয়েকটি সমস্যা এর সঙ্গে যুক্ত আছে যেগুলোর সমাধানের ওপর সব কিছু নির্ভর করবে।
প্রথমত শিক্ষার্থীদের টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত হলগুলোতে তাদের ওঠাই শুধু নয় স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের পরিবেশটাও তৈরি করতে হবে।
তৃতীয়ত করোনা সংক্রমণ নিকট ভবিষ্যতে কতটা নিম্নগামী থাকবে সেটি হচ্ছে সবচাইতে বড় প্রশ্ন। এসব নিয়েই শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, প্রশাসন এবং সরকারের মধ্যে নানা ধরণের দুশ্চিন্তা কাজ করছে।
যদি ভালোয় ভালোয় করোনা সংক্রমণ কমে আসে তাহলে বর্তমানের দুঃসময়টি কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। কিন্তু ভাইরাসের ইতিহাস থেকে যেটি অভিজ্ঞতা হয়েছে তাহচ্ছে এটি বারবার ঘুরে আসে। ১৯১৮-২০ সালে সংক্রমিত স্প্যানিশ ফ্লু দুই বছরের বেশি সময় নিয়েছিলো। তবে দ্বিতীয় ঢেউটি ছিলো সবচাইতে মারাত্মক। এরপর যখন মানুষ একটু স্বস্তিতে ফিরে এসেছিলো আবার তৃতীয় ঢেউ হানা দিয়েছিলো। সেটি অবশ্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছিলো। অতীত এই অভিজ্ঞতা থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবারই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে করোনার ঢেউ এখনই শেষ হয়ে যাবে, এমনটি কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
আমাদেরকে আরও দুই এক বছর কিংবা তারও বেশি সময় করোনার সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে থাকতে হতে পারে।
গত দেড় বছরে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটির ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজন একদিকে একটি লম্বা সময়, অন্যদিকে ব্যবসা বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ সকল মহল থেকে সৃষ্টি করা বজায় রাখা। কেন না যে ক্ষতি এইসব উদ্যোক্তাদের হয়ে গেছে তার সঙ্গে অসংখ্য শ্রমিক ও কর্মচারীর জীবন জীবিকা গভীরভাবে যুক্ত।
গত দেড় বছরে অনেকেই কাজ হারিয়েছেন, ব্যবসা বাণিজ্যে আবার প্রাণ ফিরে এলে তবেই এদের জীবন জীবিকায় স্বস্তি ফিরে আসতে পারে। তবে দেশে করোনার এ দীর্ঘ সময়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা, বাণিজ্য এবং সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
অনলাইন শপিং, হোম ডেলিভারিসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় যাদের সক্ষমতা আছে তাদের জন্য কেনাকাটায় স্বস্তির আবহ তৈরি হয়েছে। কিন্তু করোনার আগে যারা দোকানপাট বিপণি বিতান ইত্যাদিতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে ব্যবসা বাণিজ্য করছিলেন তাদের এখন ব্যবসাকে স্বাভাবিক করা, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা মোটেও সহজ হবে না। এখানে একটি বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে।
সে কারণে স্বস্তি নেই প্রচলিত ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত অনেকের। তারা কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন সেটি তাদের কপালে প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে দিচ্ছে। একদিকে অর্থনৈতিক সংকট, অন্যদিকে অনলাইন ক্রয় বিক্রয়ের প্রতিযোগিতায় পুরাতন ব্যবসা বাণিজ্যের মালিক-কর্মচারীরা আর্থিক ঝুঁকির সম্ভাবনা দেখছেন। ফলে কিভাবে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য এবং অর্থনীতির এইসব খাত আগামী দিনে ঘুরে দাঁড়াবে সেটি নির্ভর করবে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ওপর। আবার ব্যবসা বাণিজ্যে সূচিত পরিবর্তনকে কতোটা সহনীয় করা যাবে তার ওপর।
করোনা আসার পর সারাবিশ্বের মতো আমাদের দেশেও স্বাস্থ্যবিধির কার্যকারিতা বাস্তবায়নে সরকার, গণমাধ্যম, চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞরাসহ সমাজের সচেতন মহল গলদ্ঘর্ম অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু মাস্ক শতভাগ মানুষের মুখে কিছুতেই পরানো যাচ্ছে না, মানুষে মানুষে দূরত্বও বজায় রাখা যাচ্ছে না। এটি এমন একটি জটিল ব্যবস্থা যা ধাতস্থ করা মোটেও সহজ কাজ নয়। অথচ কোভিড-১৯ এমনই একটি ব্যাধি যা মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হচ্ছে। সেই সংক্রমণ রোধে মাস্ক পরাটিই প্রধান উপায়। অথচ এই মাস্কটি দেড় বছরেও মানুষকে পরতে অভ্যস্ত করা যায় নি। দ্বিতীয় যেই বিষয়টি করোনা সংক্রমণ রোধে জরুরি তা হচ্ছে টিকাকরণ। টিকাকরণ নিয়েও সংকট আমাদের কাটছে না। টিকার কূটনীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, সরবরাহের প্রাপ্তির সংকট যেন লেগেই আছে। এটি নিশ্চিত করা গেলে অদৃশ্য এ ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা সহজ হতো।
তবে মাস্ক ছাড়া এই টিকাকরণেই পুরোপুরি নির্ভার থাকা যাবে না। এখন সমস্যাটি আমাদের দেশে উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সরকার টিকা করণের যেসব উদ্যোগ এই পর্যন্ত নিয়েছে সেগুলো পরিকল্পনা মোতাবেক হয়নি। কারণ সরবরাহ অবারিত থাকেনি। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পিছু হটতে হয়েছে।
এর ফলে টিকাকরণ সামনের দিনগুলোতে কতোটা নির্বিঘ্ন থাকবে, প্রাপ্তি কতটা নিশ্চিত হবে সেটি নিয়ে ব্যপক সংখ্যক মানুষের মধ্যে হতাশা ও দুশ্চিন্তা বেড়েই চলছে। এখন সরকারের উচিত হবে বিগত দিনগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে অপরিকল্পিত ভাবে নয়। বরং পরিকল্পিতভাবে টিকা প্রাপ্তি ও প্রদানের ব্যবস্থাটি নির্বিঘ্ন করা। এক্ষেত্রে গ্রামের তৃণমূল থেকে শহরের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত টিকাকরণের পরিকল্পনাটি মাঠের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবে রূপ দেওয়া।
কোভিড-১৯ এর অভিঘাত ব্যক্তি মানুষ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় বড়ো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে- এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে সকল সচেতন মহল, প্রশাসন, রাজনীতিক দল এবং সরকারকে বর্তমান বৈশ্বিক সকল বাস্তবতা মাথায় নিয়ে দেশের সামগ্রিক স্থবিরতা, অস্থিরতা ওসমস্যা কাটিয়ে ওঠার বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাভাবনা,কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে, বৃহত্তর সমাজের মধ্যে সম্প্রীতি, নৈকট্য সৃষ্টির পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। তাহলেই অযুত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় নেবে না। এর ব্যত্যয় ঘটলে যে অস্থিরতা তৈরি হবে সেটি কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।
লেখক: অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ